নবী করিম (দঃ) মদিনায় প্রবেশ করলে আউছ ও খাযরাজ বংশের প্রত্যেকেই তাঁদের গৃহে মেহমান হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন, "আমার কায়া উট আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত। সে নিজেই ঠিক করে নেবে- আমি কার গৃহের মেহমান হবো”
উট চলতে চলতে বনী নাজ্জার গোত্রের দুই ইয়াতিম শিশু সাহল ও সোহায়ল-এর খেজুরের আড়তে এসে বসে পড়লো। এখানেই বর্তমানে মসজিদে নববী অবস্থিত। পুনরায় উঠে উট চলে গেল হযরত আবু আইউব আনসারীর (রাঃ) গৃহে। সেখানে উট বসে পড়লো। নবী করিম (দঃ) এরশাদ করলেন, 'এখানেই আমার অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে'। আবু আইউব আনসারী (রাঃ) মাল সামানা নিজ গৃহে তুলে নিলেন। তিনি নবী করিম (দঃ)-এর নানার বংশ বনু নাজ্জারের লোক ছিলেন। মদিনাবাসীদের মধ্যে তাঁর মর্যাদাই ছিল আলাদা। এভাবে উট হুযুরের বাসস্থান ও মসজিদে নববীর স্থান নির্ধারিত করে দিল। হুযুরের পরশে উটও আল্লাহর এলহামপ্রাপ্ত হয়।
এই গৃহ সম্পর্কে আল বেদায়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হুযুরের (দঃ) ১৪০০ বৎসর পূর্বে ইয়েমেন-এর বাদশাহ আবু কোরাব তিব্বা ইয়াছরিব (মদিনা) শহর ধ্বংস করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তথাকার ইয়াহুদী আলেমগণ তাঁকে বলেছিল- আপনি এই শহর ধ্বংস করতে পারবেন না। কেননা, শেষ যুগের নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) হিজরত করে এখানে স্থায়ীভাবে বাসস্থান বানাবেন। একথা শুনে তিব্বা বাদশাহ সাথে সাথে নবীজীর উপর গায়েবী ঈমান আনেন। তাঁর এই না দেখা অগ্রীম ঈমান আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। তিব্বা বাদশাহ নবী করিম (দঃ)-এর শানে একটি কবিতা লিখে হযরত আবু আইউব আনসারীর পূর্বপুরুষগণের কাছে হস্তান্তর করেন এবং বলেন-
আমার এই কবিতা বা পত্রখানা তোমরা ঐ নবীজীর খেদমতে পৌঁছিয়ে দিও। ঐ কাব্যপত্রখানা হযরত আবু আইউব আনসারীর পূর্বপুরুষগণ সযত্নে সংরক্ষণ করতে থাকেন। হযরত আবু আইউব আনসারী (রাঃ) উত্তরাধিকার সূত্রে ঐ কাব্যপত্রের মালিক হন। নবী করিম (দঃ) হযরত আবু আইউব আনসারী (রাঃ)-এর গৃহে অবস্থান করে ঐ কাব্যপত্রখানি-তলব করেন। ঐ পত্র সম্পর্কে হযরত আবু আইউব আনসারীর কিছু জানা ছিলনা। নবী করিম (দঃ) নিজে পুরাতন কাগজপত্রের মধ্য হতে উক্ত পত্রখানা বের করলেন। সকলে নবী করিম (দঃ)-এর ইলমে গায়েব দেখে হতবাক হয়ে গেলো। হযরত আবু আইউব আনসারীর (রাঃ) দোতলা বাসভবনটি ১৪০০ বৎসর পূর্বে তিব্বা বাদশাহ তৈরী করে নব করিম (দঃ)-এর জন্য উৎসর্গ করে যান। নবী করিম (দঃ)-এর উট সেই ঘরে সন্ধান করে এখানে এসে বসে পড়লো। নবীজীর সংশ্রবে এসে উটের যে বিদ্য অর্জিত হলো- তাঁর খানিকটুকু আমাদের নসিব হলে জীবন ধন্য হতো।
তিব্বা বাদশাহ্ কর্তৃক লিখিত কাব্যপত্রের কিয়দাংশ বেদায়া গ্রন্থে উদ্ধৃত কর হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো-
شَهِدْتُ عَلَى أَحْمَدَ أَنَّهُ رَسُولٌ مِنَ اللَّهِ بَارِيَ النَّسَمِ
فَلَوْ مَضَى عُمَرِي إِلَى عُمَرِهِ لَكُنْتُ وَزِيرَ لَهُ وَابْنَ عَمِّ
وَجَاهَدْتُ بِالسَّيْفِ أَعْدَاءَهُ وَفَرَجْتُ عَنْ صَدْرِهِ كُلَّ هَمِّঅর্থ-"আমি (তিব্বা) একথার উপর সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং ঈমান আছি যে, আহমদ মুজতবা (দঃ) মানবজাতির স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্বাচিত রাসুল। আমার হায়াত যদি তিনির যুগ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতো- তাহলে আমি অবশ্যই তাঁর পরামর্শক হতাম ও জ্ঞাতি ভাইয়ের ন্যায় তাঁর সাহায্যকারী হতাম। আমি তাঁর দুশমনদের বিরুদ্ধে তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করতাম এবং তাঁর মনের ব্যথা দূর করে দিতে চেষ্টা করতাম”।
(বেদায়া ও নেহায়া ২য় খন্ড ১৬ পৃষ্ঠা পুরাতন সংস্করণ)
নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেছেন: -
لَا تَسُبُّوا تَبَعْدِ فَإِنَّهُ كَانَ قَدَاسْلَمَ
"তোমরা তিব্বা বাদশাহকে মন্দ বলোনা। কেননা, সে পূর্বেই আমার উপর ঈমান এনে মুসলমান হয়েছে"।
নবী করিম (দঃ) আরও এরশাদ করেছেন-
لا تسبوا اسعد الجميرِيَّ فَإِنَّهُ أَوَّلَ مَنْ كَسَى الْكَعْبَة
অর্থ- “তোমরা আছআদ হিমইয়ারী (তিব্বা) কে মন্দ বলোনা। কেননা, সে-ই সর্বপ্রথম কা'বা ঘরকে উত্তম চাদর দ্বারা আবৃত করেছে"।
যাক-নবী করিম (দঃ) যে বৎসর মদিনায় হিজরত করেন, সে বৎসরের মুত্ররম থেকেই হিজরী সন গননা করা হয়। কেননা, সে তারিখ হতেই হিজরতের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) মুহররমের পহেলা তারিখে ৮০০ দিরহাম দিয়ে দুটি-উট কিনে নবীজীর খেদমতে পেশ করেছিলেন। ১৭ বৎসর পর হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতযুগে মুহররম মাস থেকে হিজরী সন প্রবর্তন করা হয়। এটি মুসলমানদের নিজস্ব সন। ইংরেজী সন খৃস্টানদের জন্য। বাংলা সন বাঙ্গালীদের জন্য। নওরোয অগ্নি উপাসক ইরানীদের জন্য। কিন্তু হিজরী সন সব মুসলমানদের জন্য। ধর্মীয় যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান চান্দ্রমাসকে ঘিরেই পালিত হয়। চাঁদের তারিখ ধরা হয়- পূর্ব রাত হতে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত। সুতরাং মুসলমানের মূল ক্যালেন্ডার হলো হিজরীসন।
পূর্ববর্তী পেইজ | পরবর্তী পেইজ |
(০৫৪) মদিনায় আনন্দ মিছিল | (০৫৬) মসজিদে নববী নির্মাণ |
সূচীপত্র | এরকম আরো পেইজ |