لاَ تَعْلَمُهُمْ . نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ.
-‘‘আপনি তাদেরকে জানেন না, আমি তাদেরকে জানি।’’
{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ১০১,পারাঃ ১১}
এ আয়াতে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীগণ আরও একটি প্রমাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করে বলেন যে রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে আগত মুনাফিকদেরকে রাসূল (ﷺ) চিনতেন না। তাই ইলমে গায়বের প্রশ্ন উঠতে পারে কিভাবে? তাফসীরকারকগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে, এ আয়াতের পরেই
وَلِتَعْرِ فََهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ.
(এবং নিশ্চয় তাদের কথার ধরন থেকে তাদেরকে চিনে ফেলবেন)
{সূরাঃ মুহাম্মদ, আয়াতঃ৩০, পারাঃ২৬}
আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। সুতরাং, এ আয়াতটি রহিত হিসেবে গণ্য হয়। অথবা এরকম ব্যাখ্যাও হতে পারে যে আমি (আল্লাহ বাতলিয়ে না দিলে আপনি (হে নবী (ﷺ)) তাদেরকে চিনতেন না।
‘তাফসীরে জুমালে’ এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে লিখা হয়েছেঃ
فَاِنْ قُلْتَ كَيْفَ نُفِىَ عَنْهُ عِلْمٌُ بِحَالِ الْمُنَافِقِيْنَ وَاَثْبَتَهُ فِىْ قَوْلِهِ تَعَالَى وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ فَالْجَوَابُ اَنَّ اَيَةَ النَّفِىَ نَزَلَتْ فَبْلَ اَيَةِ الْاِثْبَاتِ
অর্থাৎ- প্রশ্ন করতে পারেন যে, রাসূল (ﷺ) কর্তৃক মুনাফিকদের অবস্থা জানার বিষয়টি কেন অস্বীকার করা হলো? অথচ وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ. আয়াতে তাঁর জানার স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। এর জওয়াব হলো অস্বীকৃতিসূচক আয়াতটি স্বীকৃতিসূচক আয়াতের আগে অবতীর্ণ হয়েছিল।
একই ‘জুমালে’ وَلَتَعْرِ فَنَّهُمْ فِىْ لَحْنِ الْقَوْلِ. আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছেঃ
فَكَانَ بَعْدَ ذَلِكَ لاَيَتَكَلًَّمُ مُنَافِقً عِنْدَ النَّبِىِّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اِلاَّعَرَفَهُ وَيَسْتَدِلُّ عَلَى فَسَادِ بَاطِنِهِ وَنِفَاقِهِ
অর্থাৎ- আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মুনাফিকদের রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে কথা বলতেই রাসূল (ﷺ) তাদরেকে চিনে ফেলতেন এবং তাদের অন্তরের অসৎ উদ্দেশ্য ও কপটতার পরিচায়ক প্রমাণও উপস্থাপিত করতেন।
‘তাফসীরে বায়যাবীতে’ এ আয়াত প্রসঙ্গে লিখা আছেঃ
خَفِىَ عُلَيْكَ حَالُهُمْ مَعَ كَمَالِ فِطْنَتِكَ وَصِدْقِ فَرَاسَتِكَ
অর্থাৎ- আপনার পূর্ণবোধশক্তি ও মানুষ চিনার সঠিক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাদের (মুনাফিকদের) অবস্থা আপনার নিকট গোপন রয়ে গেছে।
{ইমাম নাসিরুদ্দিন বায়যাভীঃ তাফসিরে বায়যাভিঃ ৩/১৬৯ পৃ.}
এ তাফসীর থেকে বোঝা গেল যে, এ আয়াতে অনুমান ও আন্দাজের ভিত্তিতে জানার বিষয়টির অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে। আয়াতের এ ধরনের ব্যাখ্যাবলী গ্রহণ করা না হলে, এটা সমস্ত হাদীছের বিপরীত হয়ে যাবে, যেগুলোতে একথা প্রমাণিত যে হুযুর আলাইহস সালাম মুনাফিকদেরকে চিনতেন, কিন্তু জেনে শুনেও তাদের অবস্থা গোপন করতেন।
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আইনী’র ৪র্থ খন্ডের ২২১ পৃষ্ঠায় হযরত ইবন মসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছেঃ
خَطَبَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ يَوْمَ الْجَمْعَةِ فَقَالَ اُخْرُجْ يَافُلاَنُ فَاِنَّكَ مُنَافِقٌُ فَاَخْرَجَ مِنْهُمْ نَاسًا فَفَضَحَهُمْ
-‘‘ রাসূল (ﷺ) জুমা’র দিন খুতবা পাঠ করছিলেন। অতঃপর নাম উল্লেখপূর্বক বললেন, হে অমুক, বের হয়ে যাও। কেননা, তুমি মুনাফিক। এ রকম করে অনেক ব্যক্তিকে অপদস্থ করে বের করে দিয়েছিলেন।’’
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) রচিত ‘শরহে শিফা’ এর ১ম খন্ডের ২৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছেঃ
عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ كَانَ الْمُنَفِقُوْنِ مِنَ الرِّجَالِ ثَلَثَةَ مِاَئَةٍ وَمِنَ النِّسَاءِ مِاَئْةً وَّسَبْعِيْنَ
-‘‘হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে মুনাফিকদের পুরুষের সংখ্যা ছিল তিনশ, আর মহিলার সংখ্যা ছিল একশত সত্তর।’’
আমি ইতোপূর্বে ইলমে গায়বের সমর্থনে একটি হাদীছ পেশ করেছি।
উক্ত হাদীছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন- ‘আমার সামনে আমার সমস্ত উম্মতকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি তাদের মধ্যে মুনাফিক, কাফির ও মুমিনগণকে চিহ্নিত করেছি। এতে মুনাফিকগণ আপত্তি উত্থাপন করলো। তখন তাদের আপত্তির জওয়াবে কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। বলা বাহুল্য, যাবতীয় দলীল সমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্যে এরূপ প্রায়োগিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন। অধিকন্তু, আয়াতে বর্ণিত বক্তব্য সাধারণত ক্ষোভ প্রকাশের জন্য করা হয়ে থাকে। বাপ নিজ শিশুকে শস্তি দিবার সময় কেউ যদি রক্ষা করে তখন তিনি বলেন, এ অসভ্যকে তুমি চিন না, আমি ভালরূপে চিনি। এতে জ্ঞানের অস্বীকৃতি বুঝায় না।
وَلاَتُصَلِّ عَلَى اَحَدٍ مِّنْهُمْ مَاتَ اَبَدًا
‘‘তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে আপনি কখনও জানাযার নামায পড়বেন না।’’
{সূরাঃ তাওবাহ, আয়াতঃ ৮৪, পারাঃ ১০}
রাসূল (ﷺ) আবদুল্লাহ ইবন উবাই নামক কট্টর মুনাফিকের জানাযার নামায পড়েছিলেন কিংবা পড়তে চেয়েছিলেন। এমন সময় হযরত ফারূকে আজম (رضي الله عنه) নামায না পড়তে অনুরোধ করলেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) অনুরোধ রক্ষা করলেন না। তখনই উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, যেখানে তাঁকে মুনাফিকদের জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।
যদি তাঁর ইলমে গায়ব থাকতো, তাহলে তিনি মুনাফিকের জানাযার নামায পড়লেন কেন?
এর উত্তর হচ্ছে, হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) এ মুনাফিকের নিকট একটু ঋণী ছিলেন, এবং তার ছেলে কিন্তু খাঁটি মুমিন ছিলেন। উক্ত মুনাফিক নিজে ওসীয়ত করে গিয়েছিল যে তার জানাযার নামায যেন রাসূল (ﷺ) পড়ান। সে সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সুতরাং, তখনকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত অনুমতি অনুসারে রাসূল (ﷺ) আমল করেছিলেন।
তাফসীরে কবীর ও রূহুল বয়ানে উল্লেখিত আছে যে, তার ওসীয়ত দ্বারা তার তাওবাই প্রমাণিত হয়।
{ইমাম ফখরুদ্দিন রাজীঃ তাফসিরে কাবিরঃ ৬/১১৬পৃ.}
শরীয়তের হুকুম বাহ্যিক দিকের উপর বর্তায়। রাসূল (ﷺ) সে অনুযায়ী আমল করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ছিল না যে তাঁর হাবিব দুশমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হোক। তাই কুরআন করীম হযরত ফারুক (رضي الله عنه) এর মতের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। মোটকথা, এ বিষয়টি ইলমে গায়বের সহিত মোটেই সম্পৃক্ত নয়। আবদুল্লাহর মুনাফিক হওয়ার বিষয়টি সবার জন্য ছিল। তবুও তার জানাযার নামায আদায়ের মধ্যে অনেক কল্যাণময় দিক ছিল। দয়াময়ের বাদন্যতা ও মহানুভবতা অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ পেয়ে যায়। তা’ না হলে ইহা কিভাবে সম্ভবপর হতে পারে যে হযরত ফারুকে আজম (رضي الله عنه) যা’ জানতে পারলেন, তা’ হুজুর আলাইহিস সালাম জানতে পারলেন না?